তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছরের বন্দীত্ব বরণ :
মূসা (আঃ)-এর প্রতি অবাধ্যতা ও জিহাদ থেকে বিমুখ হওয়ার শাস্তি স্বরূপ বনু ইস্রাঈলগণকে মিসর ও শাম-এর মধ্যবর্তী একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে দীর্ঘ ৪০ বছরের জন্য বন্দী করা হয়। তাদের অবাধ্যতায় বিরক্ত ও হতাশ হয়ে নবী মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন,
قَالَ رَبِّ إِنِّي لا أَمْلِكُ إِلاَّ نَفْسِي وَأَخِيْ فَافْرُقْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْقَوْمِ الْفَاسِقِيْنَ- (المائدة ২৫)-
‘হে আমার পালনকর্তা! আমি কোন ক্ষমতা রাখি না কেবল আমার নিজের উপর ও আমার ভাইয়ের উপর ব্যতীত। অতএব আপনি আমাদের ও পাপাচারী কওমের মধ্যে ফায়ছালা করে দিন’ (মায়েদাহ ৫/২৫)। জবাবে আল্লাহ বলেন,
قَالَ فَإِنَّهَا مُحَرَّمَةٌ عَلَيْهِمْ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً يَّتِيْهُوْنَ فِي الأَرْضِ فَلاَ تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْفَاسِقِيْنَ- (المائدة ২৬)-
‘এদেশটি (বায়তুল মুক্বাদ্দাস সহ শামদেশ) চল্লিশ বছর পর্যন্ত তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হ’ল। এ সময় তারা ভূপৃষ্ঠে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ফিরবে। অতএব তুমি অবাধ্য কওমের জন্য দুঃখ করো না’ (মায়েদাহ ৫/২৬)। تَاهَ يَتِيْهُ تِيْهًا অর্থ গর্ব করা, পথ হারিয়ে ঘোরা ইত্যাদি। এখান থেকেই উক্ত প্রান্তরের নাম হয়েছে ‘তীহ্’ (تِيْه)। বস্ত্ততঃ এই উন্মুক্ত কারাগারে না ছিল কোন প্রাচীর, না ছিল কোন কারারক্ষী। তারা প্রতিদিন সকালে উঠে মিসর অভিমুখে রওয়ানা হ’ত। আর সারাদিন চলার পর রাতে আবার সেখানে এসেই উপস্থিত হ’ত, যেখান থেকে সকালে তারা রওয়ানা হয়েছিল। কিন্তু কোনভাবেই তারা অদৃশ্য কারা প্রাচীর ভেদ করে যেতে পারত না। এভাবে চল্লিশ বছর পর্যন্ত হতবুদ্ধি অবস্থায় দিগ্বিদিক ঘুরে এই হঠকারী অবাধ্য জাতি তাদের দুনিয়াবী শাস্তি ভোগ করতে থাকে। যেমন ইতিপূর্বে নূহ (আঃ)-এর অবাধ্য কওম দুনিয়াবী শাস্তি হিসাবে প্লাবণে ডুবে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। বস্ত্ততঃ চল্লিশ বছরের দীর্ঘ সময়ের মধ্যে হারূণ ও মূসা (আঃ)-এর তিন বছরের বিরতিতে মৃত্যু হয়। অতঃপর শাস্তির মেয়াদ শেষে পরবর্তী নবী ইউশা‘ বিন নূন-এর নেতৃত্বে জিহাদের মাধ্যমে তারা বায়তুল মুক্কাদ্দাস জয়ে সমর্থ হয় এবং সেখানে প্রবেশ করে। বর্ণিত হয়েছে যে, ১২ জন নেতার মধ্যে ১০ জন অবাধ্য ও ভীরু নেতা এরি মধ্যে মারা যায় এবং মূসার অনুগত ইউশা‘ ও কালেব দুই নেতাই কেবল বেঁচে থাকেন, যাদের হাতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজিত হয় (কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর মায়েদাহ ২৬)।
তীহ্ প্রান্তরের ঘটনাবলী :
নবীর সঙ্গে যে বেআদবী তারা করেছিল, তাতে আল্লাহর গযবে তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আল্লাহ পাক হয়ত এ জাতিকে আরও পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন এবং আল্লাহর অপার অনুগ্রহপুষ্ট একটি জাতি নিজেদের অবাধ্যতা ও হঠকারিতার ফলে কিভাবে আল্লাহর অভিসম্পাৎগ্রস্ত হয় এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত চিরস্থায়ী লাঞ্ছনার শিকার হয়, পৃথিবীর মানুষের নিকটে দৃষ্টান্ত হিসাবে তা পেশ করতে চেয়েছিলেন। ঠিক যেভাবে দৃষ্টান্ত হয়েছে ফেরাঊন একজন অবাধ্য ও অহংকারী নরপতি হিসাবে। আর তাই বনু ইস্রাঈলের পরীক্ষার মেয়াদ আরও বর্ধিত হ’ল। নিম্নে তাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কিছু নিদর্শন বর্ণিত হ’ল।-
১. মেঘ দ্বারা ছায়া প্রদান :
ছায়াশূন্য তপ্ত বালুকা বিস্তৃত মরুভূমিতে কাঠফাটা রোদে সবচেয়ে প্রয়োজন যেসব বস্ত্তর, তন্মধ্যে ‘ছায়া’ হ’ল সর্বপ্রধান। হঠকারী উম্মতের অবাধ্যতায় ত্যক্ত-বিরক্ত মূসা (আঃ) দয়াপরবশ হয়ে আল্লাহর নিকটে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রার্থনা নিবেদন করেছেন। দয়ালু আল্লাহ তাঁর দো‘আ সমূহ কবুল করেছেন এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তাঁর বিশেষ রহমত সমূহ নাযিল করেছেন। তন্মধ্যে একটি হ’ল উন্মুক্ত তীহ্ প্রান্তরের উপরে শামিয়ানা সদৃশ মেঘমালার মাধ্যমে শান্তিদায়ক ছায়া প্রদান করা। যেমন আল্লাহ এই অকৃতজ্ঞ জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, وَظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ ‘স্মরণ কর সে কথা, যখন আমরা তোমাদেরকে ছায়া দান করেছিলাম মেঘমালার মাধ্যমে’ (বাক্বারাহ ২/৫৭)।
২. ঝর্ণাধারার প্রবাহ :
ছায়ার পরেই গুরুত্বপূর্ণ বস্ত্ত হ’ল পানি। যার অপর নাম জীবন। পানি বিহনে তৃষ্ণার্ত পিপাসার্ত উম্মতের আহাজারিতে দয়া বিগলিত নবী মূসা স্বীয় প্রভুর নিকটে কাতর কণ্ঠে পানি প্রার্থনা করলেন। কুরআনের ভাষায়,
وَإِذِ اسْتَسْقَى مُوْسَى لِقَوْمِهِ فَقُلْنَا اضْرِبْ بِعَصَاكَ الْحَجَرَ فَانْفَجَرَتْ مِنْهُ اثْنَتَا عَشْرَةَ عَيْناً قَدْ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٍ مَّشْرَبَهُمْ كُلُوْا وَاشْرَبُوْا مِن رِّزْقِ اللهِ وَلاَ تَعْثَوْا فِي الأَرْضِ مُفْسِدِيْنَ- (البقرة ৬০)-
‘আর মূসা যখন স্বীয় জাতির জন্য পানি চাইল, তখন আমি বললাম, তোমার লাঠি দিয়ে পাথরের উপরে আঘাত কর। অতঃপর তা থেকে বেরিয়ে এলো (১২টি গোত্রের জন্য) ১২টি ঝর্ণাধারা। তাদের সব গোত্রই চিনে নিল (অর্থাৎ মূসার নির্দেশ অনুযায়ী নির্ধারণ করে নিল) নিজ নিজ ঘাট। (আমি বললাম,) তোমরা আল্লাহর দেওয়া রিযিক খাও আর পান কর। খবরদার যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়িয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/৬০)।
বস্ত্ততঃ ইহুদী জাতি তখন থেকে এযাবত পৃথিবী ব্যাপী ফাসাদ সৃষ্টি করেই চলেছে। তারা কখনোই আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেনি।
৩. মান্না ও সালওয়া খাদ্য পরিবেশন :
মরুভূমির বুকে চাষবাসের সুযোগ নেই। নেই শস্য উৎপাদন ও বাইরে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ। কয়েকদিনের মধ্যেই মওজুদ খাদ্য শেষ হয়ে গেলে হাহাকার পড়ে গেল তাদের মধ্যে। নবী মূসা (আঃ) ফের দো‘আ করলেন আল্লাহর কাছে। এবার তাদের জন্য আসমান থেকে নেমে এলো জান্নাতী খাদ্য ‘মান্না ও সালওয়া’- যা পৃথিবীর আর কোন নবীর উম্মতের ভাগ্যে জুটেছে বলে জানা যায় না।
‘মান্না’ এক প্রকার খাদ্য, যা আল্লাহ তা‘আলা বনু ইস্রাঈলদের জন্য আসমান থেকে অবতীর্ণ করতেন। আর তা ছিল দুধের চেয়েও সাদা এবং মধুর চেয়েও মিষ্টি। আর ‘সালওয়া’ হচ্ছে আসমান থেকে আগত এক প্রকার পাখি।[45] প্রথমটি দিয়ে রুটি ও দ্বিতীয়টি দিয়ে গোশতের অভাব মিটত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الْكَمْأَةُ مِنَ الْمَنِّ ‘কামআহ হ’ল মান্ন-এর অন্তর্ভুক্ত’।[46] এতে বুঝা যায় ‘মান্ন’ কয়েক প্রকারের ছিল। ইংরেজীতে ‘কামআহ’ অর্থ করা হয়েছে ‘মাশরূম’ (Mashroom)। আধুনিক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, মান্ন একপ্রকার আঠা জাতীয় উপাদেয় খাদ্য। যা শুকিয়ে পিষে রুটি তৈরী করে তৃপ্তির সাথে আহার করা যায়। ‘সালওয়া’ একপ্রকার চড়ুই পাখি, যা ঐসময় সিনাই এলাকায় প্রচুর পাওয়া যেত। ব্যাঙের ছাতার মত সহজলভ্য ও কাই জাতীয় হওয়ায় সম্ভবত একে মাশরূম-এর সাথে তুলনীয় মনে করা হয়েছে। তবে মাশরূম ও ব্যাঙের ছাতা সম্পূর্ণ পৃথক জিনিস। কয়েক লাখ বনু ইস্রাঈল কয়েক বছর ধরে মান্না ও সালওয়া খেয়ে বেঁচে ছিল। এতে বুঝা যায় যে, মান্ন ছিল চাউল বা গমের মত কার্বো-হাইড্রেট-এর উৎস এবং সালওয়া বা চড়ুই জাতীয় পাখির গোশত ছিল ভিটামিন ও চর্বির উৎস। সব মিলে তারা পরিপূর্ণ খাবার নিয়মিত খেয়ে বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। দক্ষিণ ইউরোপের সিসিলিতে, আরব উপদ্বীপের ইরাকে ও ইরানে, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতবর্ষে মান্না জাতীয় খাদ্য উৎপন্ন হয়।[47] অবাধ্য বনু ইস্রাঈলরা এগুলো সিরিয়ার তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছরের বন্দী জীবনে বিপুলভাবে পেয়েছিল আল্লাহর বিশেষ রহমতে। ঈসার সাথী হাওয়ারীগণ এটা চেয়েছিল (মায়েদাহ ৫/১১২-১১৫)। কিন্তু পেয়েছিল কি-না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
দুনিয়ায় বসেই জান্নাতের খাবার, এ এক অকল্পনীয় অনির্বচনীয় আনন্দের বিষয়। কিন্তু এই হতভাগারা তাতেও খুব বেশীদিন খুশী থাকতে পারেনি। তারা গম, তরকারি, ডাল-পেঁয়াজ ইত্যাদি খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠলো। যেমন আল্লাহ বলেন,
... وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوَى كُلُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَمَا ظَلَمُوْنَا وَلَـكِنْ كَانُوْا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُوْنَ- (البقرة ৫৭)-
‘... আমরা তোমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছি ‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’। (আমরা বললাম) এসব পবিত্র বস্ত্ত তোমরা ভক্ষণ কর (কিন্তু ওরা শুনল না, কিছু দিনের মধ্যেই তা বাদ দেওয়ার জন্য ও অন্যান্য নিম্নমানের খাদ্য খাবার জন্য যিদ ধরলো)। বস্ত্ততঃ (এর ফলে) তারা আমার কোন ক্ষতি করতে পারেনি, বরং নিজেদেরই ক্ষতি সাধন করেছে’ (বাক্বারাহ ২/৫৭)।
আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলেন,
وَإِذْ قُلْتُمْ يَا مُوْسَى لَن نَّصْبِرَ عَلَىَ طَعَامٍ وَاحِدٍ فَادْعُ لَنَا رَبَّكَ يُخْرِجْ لَنَا مِمَّا تُنْبِتُ الأَرْضُ مِنْ بَقْلِهَا وَقِثَّآئِهَا وَفُوْمِهَا وَعَدَسِهَا وَبَصَلِهَا قَالَ أَتَسْتَبْدِلُوْنَ الَّذِيْ هُوَ أَدْنَى بِالَّذِيْ هُوَ خَيْرٌ؟ إِهْبِطُوْا مِصْراً فَإِنَّ لَكُمْ مَّا سَأَلْتُمْ وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ وَالْمَسْكَنَةُ وَبَآؤُوْا بِغَضَبٍ مِّنَ اللهِ، ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَانُوْا يَكْفُرُوْنَ بِآيَاتِ اللهِ وَيَقْتُلُوْنَ النَّبِيِّيْنَ بِغَيْرِ الْحَقِّ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوْا يَعْتَدُوْنَ- (البقرة ৬১)-
‘যখন তোমরা বললে, হে মূসা! আমরা একই ধরনের খাদ্যের উপরে কখনোই ধৈর্য ধারণ করতে পারব না। কাজেই তুমি তোমার প্রভুর নিকটে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা কর তিনি যেন আমাদের জন্য এমন খাদ্য-শস্য দান করেন, যা জমিতে উৎপন্ন হয়; যেমন তরি-তরকারি, কাকুড়, গম, রসুন, ডাল, পেঁয়াজ ইত্যাদি। মূসা বললেন, তোমরা উত্তম খাদ্যের বদলে এমন খাদ্য পেতে চাও যা নিম্নস্তরের? তাহ’লে তোমরা অন্য কোন শহরে চলে যাও। সেখানে তোমরা তোমাদের চাহিদা মোতাবেক সবকিছু পাবে’ (বাক্বারাহ ২/৬১)।
৪. পার্শ্ববর্তী জনপদে যাওয়ার হুকুম ও আল্লাহর অবাধ্যতা :
বনু ইস্রাঈলগণ যখন জান্নাতী খাদ্য বাদ দিয়ে দুনিয়াবী খাদ্য খাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যিদ ধরে বসলো, তখন আল্লাহ তাদের পার্শ্ববর্তী জনপদে যেতে বললেন। যেখানে তাদের চাহিদামত খাদ্য-শস্যাদি তারা সর্বদা প্রাপ্ত হবে। উক্ত জনপদে প্রবেশের সময় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার জন্য তিনি কতগুলি আদব ও শিষ্টাচার মান্য করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তারা তাতে কর্ণপাত করল না। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ قُلْنَا ادْخُلُوْا هَـذِهِ الْقَرْيَةَ فَكُلُوْا مِنْهَا حَيْثُ شِئْتُمْ رَغَداً وَادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّداً وَّقُوْلُوْا حِطَّةٌ نَّغْفِرْ لَكُمْ خَطَايَاكُمْ وَسَنَزِيْدُ الْمُحْسِنِيْنَ- (البقرة ৫৮)-
‘আর যখন আমরা বললাম, তোমরা প্রবেশ কর এ নগরীতে এবং এতে যেখানে খুশী খেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ কর এবং নগরীর ফটক দিয়ে প্রবেশ করার সময় সিজদা কর ও বলতে থাক (হে আল্লাহ!) ‘আমাদিগকে ক্ষমা করে দাও’- তাহ’লে আমরা তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেব এবং সৎকর্মশীলদের আমরা সত্বর অতিরিক্তভাবে আরও দান করব’ (বাক্বারাহ ২/৫৮)। কিন্তু এই অবাধ্য জাতি এতটুকু আনুগত্য প্রকাশ করতেও রাযী হয়নি। তাদেরকে শুকরিয়ার সিজদা করতে বলা হয়েছিল এবং আল্লাহর নিকটে ক্ষমা চেয়ে ‘হিত্ত্বাহ’ (حطة) অর্থাৎ حُط ذنوبنا অথবাاحطط عنا ذنوبنا حطة ‘আমাদের পাপসমূহ পুরোপুরি মোচন করুন’ বলতে বলতে শহরে প্রবেশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেআদবীর চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে তারা হিত্ত্বাহ-এর বদলে ‘হিন্ত্বাহ’ (حنطة) অর্থাৎ ‘গমের দানা’ বলতে বলতে এবং সিজদা বা মাথা নীচু করার পরিবর্তে পিছন দিকে পিঠ ফিরে প্রবেশ করল।[48] এর মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে আল্লাহ পূজারীর বদলে পেটপূজারী বলে প্রমাণ করল।
এখানে هذه القرية বা ‘এই নগরী’ বলতে বায়তুল মুক্বাদ্দাসকে বুঝানো হয়েছে। যার ব্যাখ্যা মায়েদাহ ২১ আয়াতে এসেছে, الأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ বলে। তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছর বন্দী জীবন কাটানোর পর নবী ইউশা‘ বিন নূন-এর নেতৃত্বে জিহাদের মাধ্যমে তারা বিজয় লাভ করে ও নগরীতে প্রবেশ করে (ইবনু কাছীর)। এভাবে তাদের দীর্ঘ বন্দীত্বের অবসান ঘটে।
অথচ যদি প্রথমেই তারা মূসার হুকুম মেনে নিয়ে জিহাদে অবতীর্ণ হ’ত, তাহ’লে তখনই তারা বিজয়ী হয়ে নগরীতে প্রবেশ করত। কিন্তু নবীর অবাধ্যতা করার কারণেই তাদের ৪০ বছর কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হ’ল। পরিশেষে তাদেরকে সেই জিহাদই করতে হ’ল, যা তারা প্রথমে করেনি ভীরুতা ও কাপুরুষতার কারণে। বস্ত্ততঃ ভীরু ব্যক্তি ও জাতি কখনো সম্মানিত হয় না। উল্লেখ্য যে, বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উক্ত প্রধান ফটককে আজও ‘বাব হিত্ত্বাহ’ (باب حطة) বলা হয়ে থাকে (কুরতুবী)।
আল্লাহ বলেন,
فَبَدَّلَ الَّذِيْنَ ظَلَمُواْ قَوْلاً غَيْرَ الَّذِيْ قِيْلَ لَهُمْ فَأَنْزَلْنَا عَلَى الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا رِجْزاً مِّنَ السَّمَاءِ بِمَا كَانُوْا يَفْسُقُوْنَ- (البقرة ৫৯)-
‘অতঃপর যালেমরা সে কথা পাল্টে দিল, যা তাদেরকে বলতে বলা হয়েছিল। ফলে আমরা যালেমদের উপর তাদের অবাধ্যতার কারণে আসমান থেকে গযব নাযিল করলাম’ (বাক্বারাহ ২/৫৯)। তবে সেটা যে কি ধরনের গযব ছিল, সে বিষয়ে কুরআন পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। ইতিহাসও এ ব্যাপারে নীরব। তবে সাধারণতঃ এগুলি প্লেগ-মহামারী, বজ্রনিনাদ, ভূমিকম্প প্রভৃতি হয়ে থাকে। যা বিভিন্ন নবীর অবাধ্য উম্মতদের বেলায় ইতিপূর্বে হয়েছে।
শিক্ষণীয় বিষয় :
হিনত্বাহ ও হিত্ত্বাহ বলার মাধ্যমে আল্লাহ বস্ত্তবাদী ও আদর্শবাদী দু’প্রকার মানুষের পার্থক্য তুলে ধরেছেন। বস্ত্তবাদীরা বস্ত্ত পাওয়ার লোভে মানবতাকে ও মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করে। পক্ষান্তরে ধার্মিক ও আদর্শবাদীরা তাদের ধর্ম ও আদর্শ রক্ষার জন্য বস্ত্তকে উৎসর্গ করে। ফলে মানবতা রক্ষা পায় ও মানব সভ্যতা স্থায়ী হয়। বাস্তবিক পক্ষে সে যুগ থেকে এ যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন নামে বস্ত্তবাদীগণ মানবতার ধ্বংসকারী হিসাবে নিজেদেরকে চিহ্নিত করেছে। ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ এবং বর্তমানের ইরাক ও আফগানিস্তানে স্রেফ তেল লুটের জন্য তথাকথিত গণতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্ত্তবাদী রাষ্ট্রগুলির নেতাদের হুকুমে টন কে টন বোমা মেরে লাখ লাখ নিরীহ বনু আদমের হত্যাকান্ড এরই প্রমাণ বহন করে। অথচ কেবলমাত্র ধর্মই মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখে।
তওরাতের শব্দগত ও অর্থগত পরিবর্তন :
ইহুদীরা তাদের এলাহী কিতাব তওরাতের শাব্দিক পরিবর্তন নবী মূসা (আঃ)-এর জীবদ্দশায় যেমন করেছিল, অর্থগত পরিবর্তনও তারা করেছিল। যেমন মূসা (আঃ) যখন তাদের ৭০ জন নেতাকে সাথে নিয়ে তূর পাহাড়ে গেলেন। অতঃপর আল্লাহর গযবে মৃত্যুবরণ করে পুনরায় তাঁর রহমতে জীবিত হয়ে ফিরে এল, তখনও এই গর্বিত জাতি তওরাত যে আল্লাহর নাযিলকৃত গ্রন্থ এ সাক্ষ্য দেওয়ার সাথে সাথে একথাও জুড়ে দিল যে, আল্লাহ তা‘আলা সবশেষে একথাও বলেছেন যে, তোমরা যতটুকু পার, আমল কর। আর যা না পার তা আমি ক্ষমা করে দিব’। অথচ এটা ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট কথা। তাদের এই মিথ্যা সাক্ষ্যের ফলে লোকেরা বলে দিল যে, তওরাতের বিধান সমূহ মেনে চলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
তখনই আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতাগণ তূর পাহাড়ের একাংশ উপরে তুলে ধরে তাদের হুকুম দিলেন, হয় তোমরা তওরাত মেনে নাও, না হয় ধ্বংস হও। তখন নিরুপায় হয়ে তারা তওরাত মেনে নেয়।[49]
মূসা (আঃ)-এর মৃত্যুর পরেও তওরাত, যবূর ও ইঞ্জীল গ্রন্থগুলিতে তারা অসংখ্য শব্দগত ও অর্থগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ফলে এই কিতাবগুলি আসল রূপে কোথাও আর পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই। ইহুদীদের তওরাত পরিবর্তনের ধরন ছিল তিনটি। এক. অর্থ ও মর্মগত পরিবর্তন, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। দুই. শব্দগত পরিবর্তন যেমন আল্লাহ বলেন, مِّنَ الَّذِينَ هَادُواْ يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَن مَّوَاضِعِهِ، ‘ইহুদীদের মধ্যে একটা দল আছে, যারা আল্লাহর কালামকে (যেখানে শেষনবীর আগমন সংবাদ ও তাঁর গুণাবলী সম্বন্ধে বর্ণিত হয়েছে) তার স্বস্থান হ’তে পরিবর্তন করে দেয়’ (নিসা ৪/৪৬; মায়েদাহ ৫/১৩, ৪১)। এই পরিবর্তন তারা নিজেদের দুনিয়াবী স্বার্থে শাব্দিকভাবে এবং মর্মগতভাবে উভয়বিধ প্রকারে করত। ‘এভাবে তারা কখনো শব্দে, কখনো অর্থে এবং কখনো তেলাওয়াতে (মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে) পরিবর্তন করত। পরিবর্তনের এ প্রকারগুলি কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। আজকাল পাশ্চাত্যের কিছু সংখ্যক খ্রীষ্টানও একথা কিছু কিছু স্বীকার করে’।[50]
আল্লাহর কিতাবের এইসব পরিবর্তন তাদের মধ্যকার আলেম ও যাজক শ্রেণীর লোকেরাই করত, সাধারণ মানুষ যাদেরকে অন্ধ ভক্তির চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَيْلٌ لِّلَّذِيْنَ يَكْتُبُوْنَ الْكِتَابَ بِأَيْدِيْهِمْ ثُمَّ يَقُوْلُوْنَ هَـذَا مِنْ عِنْدِ اللهِ لِيَشْتَرُوْا بِهِ ثَمَناً قَلِيْلاً- (البقرة ৭৯)-
‘ধ্বংস ঐসব লোকদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে বলত, এটি আল্লাহর পক্ষ হ’তে অবতীর্ণ হয়েছে- যাতে এর বিনিময়ে তারা সামান্য অর্থ উপার্জন করতে পারে’ (বাক্বারাহ ২/৭৯)।
আল্লাহ বলেন, سَمَّاعُونَ لِلْكَذِبِ أَكَّالُونَ لِلسُّحْتِ ‘এইসব লোকেরা মিথ্যা কথা শোনাতে এবং হারাম ভক্ষণে অভ্যস্ত’ (মায়েদাহ ৫/৪২)। জনগণ তাদের কথাকেই সত্য ভাবত এবং এর বিপরীত কিছুই তারা শুনতে চাইত না। এভাবে তারা জনগণের রব-এর আসন দখল করেছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, اتَّخَذُواْ أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَاباً مِّنْ دُونِ اللهِ ‘তারা তাদের আলেম ও দরবেশগণকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছিল আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে’ (তওবাহ ৯/৩১)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, إِنَّهُمْ لَمْ يَأمُرُوْهُمْ أَنْ يَّسْجُدُوْا لَهُمْ وَلَكِنْ أَمَرُوْهُمْ بِمَعْصِيَةِ اللهِ فَأَطَاعُوْهُمْ فَسَمَّاهُمُ اللهُ بِذَالِكَ أَرْبَاباً- ‘তারা তাদেরকে সিজদা করতে বলত না বটে। কিন্তু মানুষকে তারা আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কাজের নির্দেশ দিত এবং তারা তা মেনে নিত। সেকারণ আল্লাহ তাদেরকে ‘রব’ বলে আখ্যায়িত করেন’। খৃষ্টান পন্ডিত ‘আদী বিন হাতেম যখন বললেন যে, لَسْنَا نَعْبُدُهُمْ ‘আমরা আমাদের আলেম-দরবেশদের পূজা করি না’। তখন তার জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَلَيْسَ يُحَرِّمُوْنَ مَا أحَّل اللهُ فَتُحَرِّمُوْنَهُ وَ يُحِلُّوْنَ مَا حَرَّمَ اللهُ فَتُحِلُّوْنَهُ ‘তারা কি আল্লাহকৃত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করে না? আর তোমরাও কি সেটা মেনে নাও না? ‘আদী বললেন, হাঁ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ ‘সেটাই তো ওদের ইবাদত হ’ল’।[51]
Sunday, May 24, 2015
হযরত মূসা ও হারুন (আঃ) এর ৭ম অংশ
Tags
# নবীদের কাহিনী
About Unknown
Templatesyard is a blogger resources site is a provider of high quality blogger template with premium looking layout and robust design. The main mission of templatesyard is to provide the best quality blogger templates.
নবীদের কাহিনী
লেবেলসমূহ:
নবীদের কাহিনী
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment