মূসা ও ফেরাঊনের কাহিনী :
সুদ্দী ও মুররাহ প্রমুখ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস ও আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) এবং বহু সংখ্যক ছাহাবী থেকে বর্ণনা করেন যে, ফেরাঊন একদা স্বপ্নে দেখেন যে, বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিক হ’তে একটি আগুন এসে মিসরের ঘর-বাড়ি ও মূল অধিবাসী ক্বিবতীদের জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অথচ অভিবাসী বনু ইস্রাঈলদের কিছুই হচ্ছে না। ভীত-চকিত অবস্থায় তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। অতঃপর দেশের বড় বড় জ্যোতিষী ও জাদুকরদের সমবেত করলেন এবং তাদের সম্মুখে স্বপ্নের বৃত্তান্ত বর্ণনা দিলেন ও এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। জ্যোতিষীগণ বলল যে, অতি সত্বর বনু ইস্রাঈলের মধ্যে একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে। যার হাতে মিসরীয়দের ধ্বংস নেমে আসবে’।[14]
মিসর সম্রাট ফেরাঊন জ্যোতিষীদের মাধ্যমে যখন জানতে পারলেন যে, অতি সত্বর ইস্রাঈল বংশে এমন একটা পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, যে তার সাম্রাজ্যের পতন ঘটাবে। তখন উক্ত সন্তানের জন্ম রোধের কৌশল হিসাবে ফেরাঊন বনু ইস্রাঈলদের ঘরে নবজাত সকল পুত্র সন্তানকে ব্যাপকহারে হত্যার নির্দেশ দিল। উদ্দেশ্য ছিল, এভাবে হত্যা করতে থাকলে এক সময় বনু ইস্রাঈল কওম যুবক শূন্য হয়ে যাবে। বৃদ্ধরাও মারা যাবে। মহিলারা সব দাসীবৃত্তিতে বাধ্য হবে। অথচ বনু ইস্রাঈলগণ ছিল মিসরের শাসক শ্রেণী এবং উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন জাতি। এই দূরদর্শী কপট পরিকল্পনা নিয়ে ফেরাঊন ও তার মন্ত্রীগণ সারা দেশে একদল ধাত্রী মহিলা ও ছুরিধারী জাল্লাদ নিয়োগ করে। মহিলারা বাড়ী বাড়ী গিয়ে বনু ইস্রাঈলের গর্ভবতী মহিলাদের তালিকা করত এবং প্রসবের দিন হাযির হয়ে দেখত, ছেলে না মেয়ে। ছেলে হ’লে পুরুষ জাল্লাদকে খবর দিত। সে এসে ছুরি দিয়ে মায়ের সামনে সন্তানকে যবহ করে ফেলে রেখে চলে যেত।[15] এভাবে বনু ইস্রাঈলের ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেল। ইবনু কাছীর বলেন, একাধিক মুফাসসির বলেছেন যে, শাসকদল ক্বিবতীরা ফেরাঊনের কাছে গিয়ে অভিযোগ করল যে, এভাবে পুত্র সন্তান হত্যা করায় বনু ইস্রাঈলের কর্মজীবী ও শ্রমিক শ্রেণীর ঘাটতি হচ্ছে। যাতে তাদের কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে। তখন ফেরাঊন এক বছর অন্তর অন্তর পুত্র হত্যার নির্দেশ দেয়। এতে বাদ পড়া বছরে হারূণের জন্ম হয়। কিন্তু হত্যার বছরে মূসার জন্ম হয়।[16] ফলে পিতা-মাতা তাদের নবজাত সন্তানের নিশ্চিত হত্যার আশংকায় দারুণভাবে ভীত হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ মূসা (আঃ)-এর মায়ের অন্তরে ‘ইলহাম’ করেন। যেমন আল্লাহ পরবর্তীতে মূসাকে বলেন,
وَلَقَدْ مَنَنَّا عَلَيْكَ مَرَّةً أُخْرَى- إِذْ أَوْحَيْنَا إِلَى أُمِّكَ مَا يُوحَى- أَنِ اقْذِ فِيهِ فِي التَّابُوتِ فَاقْذِ فِيهِ فِي الْيَمِّ فَلْيُلْقِهِ الْيَمُّ بِالسَّاحِلِ يَأْخُذْهُ عَدُوٌّ لِّي وَعَدُوٌّ لَّهُ وَأَلْقَيْتُ عَلَيْكَ مَحَبَّةً مِّنِّي وَلِتُصْنَعَ عَلَى عَيْنِي- (طه ৩৭-৩৯)-
‘আমরা তোমার উপর আরো একবার অনুগ্রহ করেছিলাম’। ‘যখন আমরা তোমার মাকে প্রত্যাদেশ করেছিলাম, যা প্রত্যাদেশ করা হয়’। ‘(এই মর্মে যে,) তোমার নবজাত সন্তানকে সিন্দুকে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দাও’। ‘অতঃপর নদী তাকে তীরে ঠেলে দেবে। অতঃপর আমার শত্রু ও তার শত্রু (ফেরাঊন) তাকে উঠিয়ে নেবে এবং আমি তোমার উপর আমার পক্ষ হ’তে বিশেষ মহববত নিক্ষেপ করেছিলাম এবং তা এজন্য যে, তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও’ (ত্বোয়াহা ২০/৩৭-৩৯)। বিষয়টি আল্লাহ অন্যত্র বলেন এভাবে,
وَأَوْحَيْنَا إِلَى أُمِّ مُوسَى أَنْ أَرْضِعِيْهِ فَإِذَا خِفْتِ عَلَيْهِ فَأَلْقِيْهِ فِي الْيَمِّ وَلاَ تَخَافِي وَلاَ تَحْزَنِي إِنَّا رَادُّوهُ إِلَيْكِ وَجَاعِلُوهُ مِنَ الْمُرْسَلِينَ- (القصص ৭)-
‘আমরা মূসার মায়ের কাছে প্রত্যাদেশ করলাম এই মর্মে যে, তুমি ছেলেকে দুধ পান করাও। অতঃপর তার জীবনের ব্যাপারে যখন শংকিত হবে, তখন তাকে নদীতে নিক্ষেপ করবে। তুমি ভীত হয়ো না ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। আমরা ওকে তোমার কাছেই ফিরিয়ে দেব এবং ওকে নবীদের অন্তর্ভুক্ত করব’ (ক্বাছাছ ২৮/৭)। মূলতঃ শেষের দু’টি ওয়াদাই তাঁর মাকে নিশ্চিন্ত ও উদ্বুদ্ধ করে। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَأَصْبَحَ فُؤَادُ أُمِّ مُوْسَى فَارِغاً إِنْ كَادَتْ لَتُبْدِيْ بِهِ لَوْلاَ أَن رَّبَطْنَا عَلَى قَلْبِهَا لِتَكُوْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ- (القصص ১০)-
‘মূসা জননীর অন্তর (কেবলি মূসার চিন্তায়) বিভোর হয়ে পড়ল। যদি আমরা তার অন্তরকে সুদৃঢ় করে না দিতাম, তাহ’লে সে মূসার (জন্য অস্থিরতার) বিষয়টি প্রকাশ করেই ফেলত। (আমরা তার অন্তরকে দৃঢ় করেছিলাম এ কারণে যে) সে যেন আল্লাহর উপরে প্রত্যয়শীলদের অন্তর্ভুক্ত থাকে’ (ক্বাছাছ ২৮/১০)।
মূসা নদীতে নিক্ষিপ্ত হ’লেন :
ফেরাঊনের সৈন্যদের হাতে নিহত হবার নিশ্চিত সম্ভাবনা দেখা দিলে আল্লাহর প্রত্যাদেশ (ইলহাম) অনুযায়ী পিতা-মাতা তাদের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে সিন্দুকে ভরে বাড়ীর পাশের নীল নদীতে ভাসিয়ে দিলেন।[17] অতঃপর স্রোতের সাথে সাথে সিন্দুকটি এগিয়ে চলল। ওদিকে মূসার (বড়) বোন তার মায়ের হুকুমে (ক্বাছাছ ২৮/১১) সিন্দুকটিকে অনুসরণ করে নদীর কিনারা দিয়ে চলতে লাগল (ত্বোয়াহা ২০/৪০)। এক সময় তা ফেরাঊনের প্রাসাদের ঘাটে এসে ভিড়ল। ফেরাঊনের পুণ্যবতী স্ত্রী আসিয়া (آسية ) বিনতে মুযাহিম ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চাটিকে দেখে অভিভূত হয়ে পড়লেন। ফেরাঊন তাকে বনু ইস্রাঈল সন্তান ভেবে হত্যা করতে চাইল। কিন্তু সন্তানহীনা স্ত্রীর অপত্য স্নেহের কারণে তা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ফেরাঊন নিজে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কারণ আল্লাহ মূসার চেহারার মধ্যে বিশেষ একটা মায়াময় কমনীয়তা দান করেছিলেন (ত্বোয়াহা ২০/৩৯)। যাকে দেখলেই মায়া পড়ে যেত। ফেরাঊনের হৃদয়ের পাষাণ গলতে সেটুকুই যথেষ্ট ছিল। বস্ত্ততঃ এটাও ছিল আল্লাহর মহা পরিকল্পনারই অংশ বিশেষ। ফুটফুটে শিশুটিকে দেখে ফেরাঊনের স্ত্রী তার স্বামীকে বললেন,
وَقَالَتِ امْرَأَتُ فِرْعَوْنَ قُرَّتُ عَيْنٍ لِّي وَلَكَ لاَ تَقْتُلُوهُ عَسَى أَن يَّنْفَعَنَا أَوْ نَتَّخِذَهُ وَلَداً وَهُمْ لاَ يَشْعُرُوْنَ- (القصص ৯)-
‘এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি। একে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে পুত্র করে নিতে পারি’। আল্লাহ বলেন, ‘অথচ তারা (আমার কৌশল) বুঝতে পারল না’ (ক্বাছাছ ২৮/৯)। মূসা এক্ষণে ফেরাঊনের স্ত্রীর কোলে পুত্রস্নেহ পেতে শুরু করলেন। অতঃপর বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য রাণীর নির্দেশে বাজারে বহু ধাত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়া হ’ল। কিন্তু মূসা কারুরই বুকে মুখ দিচ্ছেন না। আল্লাহ বলেন, وَحَرَّمْنَا عَلَيْهِ الْمَرَاضِعَ مِن قَبْلُ- (القصص ১২)- ‘আমরা পূর্ব থেকেই অন্যের দুধ খাওয়া থেকে মূসাকে বিরত রেখেছিলাম’ (ক্বাছাছ ২৮/১২)। এমন সময় অপেক্ষারত মূসার ভগিনী বলল, ‘আমি কি আপনাদেরকে এমন এক পরিবারের খবর দিব, যারা আপনাদের জন্য এ শিশু পুত্রের লালন-পালন করবে এবং তারা এর শুভাকাংখী’? (ক্বাছাছ ২৮/১২)। রাণীর সম্মতিক্রমে মূসাকে প্রস্তাবিত ধাত্রীগৃহে প্রেরণ করা হ’ল। মূসা খুশী মনে মায়ের দুধ গ্রহণ করলেন। অতঃপর মায়ের কাছে রাজকীয় ভাতা ও উপঢৌকনাদি প্রেরিত হ’তে থাকল।[18] এভাবে আল্লাহর অপার অনুগ্রহে মূসা তার মায়ের কোলে ফিরে এলেন। এভাবে একদিকে পুত্র হত্যার ভয়ংকর আতংক হ’তে মা-বাবা মুক্তি পেলেন ও নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া সন্তানকে পুনরায় বুকে ফিরে পেয়ে তাদের হৃদয় শীতল হ’ল। অন্যদিকে বহু মূল্যের রাজকীয় ভাতা পেয়ে সংসার যাত্রা নির্বাহের দুশ্চিন্তা হ’তে তারা মুক্ত হ’লেন। সাথে সাথে সম্রাট নিয়োজিত ধাত্রী হিসাবে ও সম্রাট পরিবারের সাথে বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার ফলে তাঁদের পরিবারের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পেল। এভাবেই ফেরাঊনী কৌশলের উপরে আল্লাহর কৌশল বিজয়ী হ’ল। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
আল্লাহ বলেন, وَمَكَرُوا مَكْراً وَمَكَرْنَا مَكْراً وَهُمْ لاَ يَشْعُرُونَ- (النمل ৫০)- ‘তারা চক্রান্ত করেছিল এবং আমরাও কৌশল করেছিলাম। কিন্তু তারা (আমাদের কৌশল) বুঝতে পারেনি’ (নমল ২৭/৫০)।
যৌবনে মূসা :
দুগ্ধ পানের মেয়াদ শেষে মূসা অতঃপর ফেরাঊন-পুত্র হিসাবে তার গৃহে শান-শওকতের মধ্যে বড় হ’তে থাকেন। আল্লাহর রহমতে ফেরাঊনের স্ত্রীর অপত্য স্নেহ ছিল তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় দুনিয়াবী রক্ষাকবচ। এভাবে وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَاسْتَوَى آتَيْنَاهُ حُكْماً وَعِلْماً وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ- (القصص ১৪)- ‘যখন তিনি যৌবনে পদার্পণ করলেন এবং পূর্ণবয়ষ্ক মানুষে পরিণত হ’লেন, তখন আল্লাহ তাকে বিশেষ প্রজ্ঞা ও জ্ঞান সম্পদে ভূষিত করলেন’ (ক্বাছাছ ২৮/১৪)।
মূসা সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্যকভাবে উপলব্ধি করলেন। দেখলেন যে, পুরা মিসরীয় সমাজ ফেরাঊনের একচ্ছত্র রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনে কঠোরভাবে শাসিত। ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ এই সুপরিচিত ঘৃণ্য নীতির অনুসরণে ফেরাঊন তার দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল ও একটি দলকে দুর্বল করে দিয়েছিল (ক্বাছাছ ২৮/৪)। আর সেটি হ’ল বনু ইস্রাঈল। প্রতিদ্বন্দ্বী জন্মাবার ভয়ে সে তাদের নবজাতক পুত্র সন্তানদের হত্যা করত ও কন্যা সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখত। এভাবে একদিকে ফেরাঊন অহংকারে স্ফীত হয়ে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ পালনকর্তা ও সর্বাধিপতি’ ভেবে সারা দেশে অনর্থ সৃষ্টি করছিল। এমনকি সে নিজেকে ‘একমাত্র উপাস্য’ مَاعَلمْتُ لَكُمْ مِنْ إلَهٍ غَيْرِىْ- (القصص ৩৮)- (ক্বাছাছ ২৮/৩৮) বলতেও লজ্জাবোধ করেনি। অন্যদিকে মযলূম বনু ইস্রাঈলদের হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। অবশেষে আল্লাহ মযলূমদের ডাকে সাড়া দিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘দেশে যাদেরকে দুর্বল করা হয়েছিল, আমরা চাইলাম তাদের উপরে অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতা করতে ও দেশের উত্তরাধিকারী করতে’। ‘এবং আমরা চাইলাম তাদেরকে দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে এবং ফেরাঊন, হামান ও তাদের সেনাবাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে, যা তারা সেই দুর্বল দলের তরফ থেকে আশংকা করত’ (ক্বাছাছ ২৮/৫-৬)।
যুবক মূসা খুনী হ’লেন :
মূসার হৃদয় মযলূমদের প্রতি করুণায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ওদিকে আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্য রকম। মূসা একদিন দুপুরের অবসরে শহরে বেড়াতে বেরিয়েছেন। এমন সময় তাঁর সামনে এক কান্ড ঘটে গেল। তিনি দুই ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখতে পেলেন। যাদের একজন যালেম সম্রাটের ক্বিবতী বংশের এবং অন্যজন মযলূম বনু ইস্রাঈলের। মূসা তাদের থামাতে গিয়ে যালেম লোকটিকে একটা ঘুষি মারলেন। কি আশ্চর্য লোকটি তাতেই অক্কা পেল। মূসা দারুণভাবে অনুতপ্ত হলেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,
وَدَخَلَ الْمَدِيْنَةَ عَلَى حِيْنِ غَفْلَةٍ مِّنْ أَهْلِهَا فَوَجَدَ فِيْهَا رَجُلَيْنِ يَقْتَتِلاَنِ هَذَا مِنْ شِيْعَتِهِ وَهَذَا مِنْ عَدُوِّهِ فَاسْتَغَاثَهُ الَّذِيْ مِنْ شِيْعَتِهِ عَلَى الَّذِيْ مِنْ عَدُوِّهِ فَوَكَزَهُ مُوسَى فَقَضَى عَلَيْهِ قَالَ هَذَا مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ عَدُوٌّ مُّضِلٌّ مُّبِيْنٌ- قَالَ رَبِّ إِنِّيْ ظَلَمْتُ نَفْسِيْ فَاغْفِرْ لِيْ فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ- (القصص ১৫-১৬)-
‘একদিন দুপুরে তিনি শহরে প্রবেশ করলেন, যখন অধিবাসীরা ছিল দিবানিদ্রার অবসরে। এ সময় তিনি দু’জন ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখতে পেলেন। এদের একজন ছিল তার নিজ গোত্রের এবং অপরজন ছিল শত্রুদলের। অতঃপর তার নিজ দলের লোকটি তার শত্রুদলের লোকটির বিরুদ্ধে তার কাছে সাহায্য চাইল। তখন মূসা তাকে ঘুষি মারলেন এবং তাতেই তার মৃত্যু হয়ে গেল। মূসা বললেন, ‘নিশ্চয়ই এটি শয়তানের কাজ। সে মানুষকে বিভ্রান্তকারী প্রকাশ্য শত্রু’। ‘হে আমার প্রভু! আমি নিজের উপরে যুলুম করেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। অতঃপর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ক্বাছাছ ২৮/১৫-১৬)।
পরের দিন ‘জনৈক ব্যক্তি ছুটে এসে মূসাকে বলল, হে মূসা! আমি তোমার শুভাকাংখী। তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি যে, এই মুহূর্তে তুমি এখান থেকে বের হয়ে চলে যাও। কেননা সম্রাটের পারিষদবর্গ তোমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে’ (ক্বাছাছ ২৮/২০)। এই লোকটি মূসার প্রতি আকৃষ্ট ও তাঁর গুণমুগ্ধ ছিল। একথা শুনে ভীত হয়ে মূসা সেখান থেকে বের হয়ে পড়লেন নিরুদ্দেশ যাত্রাপথে। যেমন আল্লাহ বলেন,
فَخَرَجَ مِنْهَا خَائِفاً يَّتَرَقَّبُ قَالَ رَبِّ نَجِّنِيْ مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِيْنَ- وَلَمَّا تَوَجَّهَ تِلْقَاءَ مَدْيَنَ قَالَ عَسَى رَبِّيْ أَنْ يَّهْدِيَنِيْ سَوَاءَ السَّبِيْلِ- (القصص ২১-২২)-
‘অতঃপর তিনি সেখান থেকে ভীত অবস্থায় বের হয়ে পড়লেন পথ দেখতে দেখতে এবং বললেন, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে রক্ষা কর’। ‘এরপর যখন তিনি (পার্শ্ববর্তী রাজ্য) মাদিয়ান অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন, তখন (দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে) বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই আমার প্রভু আমাকে সরল পথ দেখাবেন’ (ক্বাছাছ ২৮/২১-২২)।
আসলে আল্লাহ চাচ্ছিলেন, ফেরাঊনের রাজপ্রাসাদ থেকে মূসাকে বের করে নিতে এবং সাধারণ মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে পরিচিত করতে। সাথে সাথে আল্লাহ তাঁকে তৎকালীন একজন শ্রেষ্ঠ নবীর গৃহে লালিত-পালিত করে তাওহীদের বাস্তব শিক্ষায় আগাম পরিপক্ক করে নিতে চাইলেন।
মূসার পরীক্ষা সমূহ :
অন্যান্য নবীদের পরীক্ষা হয়েছে সাধারণতঃ নবুঅত লাভের পরে। কিন্তু মূসার পরীক্ষা শুরু হয়েছে তার জন্ম লাভের পর থেকেই। বস্ত্ততঃ নবুঅত প্রাপ্তির পূর্বে ও পরে তাঁর জীবনে বহু পরীক্ষা হয়েছে। যেমন আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে শুনিয়ে বলেন, وَفَتَنَّاكَ فُتُوْنًا ‘আর আমরা তোমাকে অনেক পরীক্ষায় ফেলেছি’ (ত্বোয়াহা ২০/৪০)।
নবুঅত লাভের পূর্বে তাঁর প্রধান পরীক্ষা ছিল তিনটি। যথাঃ (১) হত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া (২) মাদিয়ানে হিজরত (৩) মাদিয়ান থেকে মিসর যাত্রা।
অতঃপর নবুঅত লাভের পর তাঁর পরীক্ষা হয় প্রধানতঃ চারটিঃ (১) জাদুকরদের মুকাবিলা (২) ফেরাঊনের যুলুমসমূহ মুকাবিলা (৩) সাগরডুবির পরীক্ষা (৪) বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান।
নবুঅত-পূর্ব ১ম পরীক্ষা : হত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া
মূসার জন্ম হয়েছিল তাঁর কওমের উপরে আপতিত রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের ভয়ংকর বিভীষিকার মধ্যে। আল্লাহ তাঁকে অপূর্ব কৌশলের মাধ্যমে বাঁচিয়ে নেন। অতঃপর তাঁর জানী দুশমনের ঘরেই তাঁকে নিরাপদে ও সসম্মানে লালন-পালন করালেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মা ও পরিবারকে করলেন উচ্চতর সামাজিক মর্যাদায় উন্নীত। অথচ মূসার জন্মকে ঠেকানোর জন্যই ফেরাঊন তার পশুশক্তির মাধ্যমে বনু ইস্রাঈলের শত শত শিশু পুত্রকে হত্যা করে চলছিল। এ বিষয়ে ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।
২য় পরীক্ষা : মাদিয়ানে হিজরত
অতঃপর যৌবনকালে তাঁর দ্বিতীয় পরীক্ষা হ’ল- হিজরতের পরীক্ষা। মূলতঃ এটাই ছিল তাঁর জ্ঞানবুদ্ধি হবার পরে ১ম পরীক্ষা। শেষনবী সহ অন্যান্য নবীর জীবনে সাধারণতঃ নবুঅতপ্রাপ্তির পরে হিজরতের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। কিন্তু মূসা (আঃ)-এর জীবনে নবুঅত প্রাপ্তির আগেই এই কঠিন পরীক্ষা উপস্থিত হয়। অনাকাংখিত ও আকস্মিক হত্যাকান্ডের আসামী হয়ে জীবনের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত্র মূসা ফেরাঊনের রাজ্যসীমা ছেড়ে কপর্দকহীন অবস্থায় পার্শ্ববর্তী রাজ্য মাদিয়ানে গিয়ে উপস্থিত হ’লেন। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় কাতর মূসা এই ভীতিকর দীর্ঘ সফরে কিভাবে চলেছেন, কি খেয়েছেন সেসব বিষয়ে তাফসীরকারগণ বিভিন্ন চমকপ্রদ ঘটনাবলী উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কুরআন এসব বিষয়ে চুপ থেকেছে বিধায় আমরাও চুপ থাকছি। তবে রওয়ানা হবার সময় যেহেতু মূসা নিজেকে সম্পূর্ণরূপে স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহর উপরে সমর্পণ করেছিলেন এবং প্রত্যাশা করেছিলেন ‘নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা আমাকে সরল পথ দেখাবেন’ (ক্বাছাছ ২৮/২২), অতএব তাঁকে মাদিয়ানের মত অপরিচিত রাজ্যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া ও সসম্মানে সেখানে বসবাস করার যাবতীয় দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যে, সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে নিজেকে সঁপে দিলে আল্লাহ তাঁর নেককার বান্দাদের সব দায়িত্ব নিজে নিয়ে থাকেন। উল্লেখ্য যে, বর্তমান পূর্ব জর্দানের মো‘আন (معان ) সামুদ্রিক বন্দরের অনতিদূরেই ‘মাদইয়ান’ অবস্থিত।
মাদিয়ানের জীবন : বিবাহ ও সংসার পালন
মাদিয়ানে প্রবেশ করে তিনি পানির আশায় একটা কূপের দিকে গেলেন। সেখানে পানি প্রার্থী লোকদের ভিড়ের অদূরে দু’টি মেয়েকে তাদের তৃষ্ণার্ত পশুগুলি সহ অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁর হৃদয় উথলে উঠলো। কেউ তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপই করছে না। মূসা নিজে মযলূম। তিনি মযলূমের ব্যথা বুঝেন। তাই কিছুক্ষণ ইতঃস্তত করে মেয়ে দু’টির দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি তাদের সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, ‘আমরা আমাদের পশুগুলিকে পানি পান করাতে পারি না, যতক্ষণ না রাখালরা তাদের পশুগুলিকে পানি পান করিয়ে চলে যায়। অথচ আমাদের পিতা খুবই বৃদ্ধ’ (যিনি ঘরে বসে আমাদের অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে আছেন)। ‘অতঃপর তাদের পশুগুলি এনে মূসা পানি পান করালেন’ (তারপর মেয়ে দু’টি পশুগুলি নিয়ে বাড়ী চলে গেল)। মূসা একটি গাছের ছায়ায় বসে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন,رَبِّ إِنِّي لِمَا أَنزَلْتَ إِلَيَّ مِنْ خَيْرٍ فَقِيرٌ- (القصص ২৪)-
‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমার উপর যে অনুগ্রহ নাযিল করবে, আমি তার মুখাপেক্ষী’ (ক্বাছাছ ২৮/২৪)। হঠাৎ দেখা গেল যে ‘বালিকাদ্বয়ের একজন সলজ্জ পদক্ষেপে তাঁর দিকে আসছে’। মেয়েটি এসে ধীর কণ্ঠে তাকে বলল, ‘আমার পিতা আপনাকে ডেকেছেন, যাতে আপনি যে আমাদেরকে পানি পান করিয়েছেন, তার বিনিময় স্বরূপ আপনাকে পুরস্কার দিতে পারেন’ (ক্বাছাছ ২৮/২৩-২৫)।
উল্লেখ্য যে, বালিকাদ্বয়ের পিতা ছিলেন মাদইয়ান বাসীদের নিকটে প্রেরিত বিখ্যাত নবী হযরত শু‘আয়েব (আঃ)। মূসা ইতিপূর্বে কখনো তাঁর নাম শোনেননি বা তাঁকে চিনতেন না। তাঁর কাছে পৌঁছে মূসা তাঁর বৃত্তান্ত সব বর্ণনা করলেন। শু‘আয়েব (আঃ) সবকিছু শুনে বললেন, لاَتَخَفْ نَجَوْتَ مِنَ الْقَوْمِ الْظَالِمِيْنَ، ‘ভয় করো না। তুমি যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছ’। ‘এমন সময় বালিকাদ্বয়ের একজন বলল, আববা! এঁকে বাড়ীতে কর্মচারী হিসাবে রেখে দিন। কেননা إِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْأَمِينُ আপনার কর্ম সহায়ক হিসাবে সেই-ই উত্তম হবে, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’ (ক্বাছাছ ২৮/২৬)। ‘তখন তিনি মূসাকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিবাহ দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার বাড়ীতে কর্মচারী থাকবে। তবে যদি দশ বছর পূর্ণ করো, সেটা তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ চাহেন তো তুমি আমাকে সদাচারী হিসাবে পাবে’। ‘মূসা বলল, আমার ও আপনার মধ্যে এই চুক্তি স্থির হ’ল। দু’টি মেয়াদের মধ্য থেকে যেকোন একটি পূর্ণ করলে আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকবে না। আমরা যা বলছি, আল্লাহ তার উপরে তত্ত্বাবধায়ক’ (ক্বাছাছ ২৮/২৫-২৮)। মূলতঃ এটাই ছিল তাদের বিয়ের মোহরানা। সেযুগে এ ধরনের রেওয়াজ অনেকের মধ্যে চালু ছিল। যেমন ইতিপূর্বে ইয়াকূব (আঃ) তাঁর স্ত্রীর মোহরানা বাবদ সাত বছর শ্বশুর বাড়ীতে মেষ চরিয়েছেন। এভাবে অচেনা-অজানা দেশে এসে মূসা (আঃ) অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান এবং অন্যান্য নিরাপত্তাসহ অত্যন্ত মর্যাদাবান ও নির্ভরযোগ্য একজন অভিভাবক পেয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে পেলেন জীবন সাথী একজন পতি-পরায়ণা বুদ্ধিমতী স্ত্রী। অতঃপর সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে মূসার দিনগুলি অতিবাহিত হ’তে থাকলো। সময় গড়িয়ে এক সময় মেয়াদ পূর্ণ হ’য়ে গেল। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তিনি চাকুরীর বাধ্যতামূলক আট বছর এবং ঐচ্ছিক দু’বছর মেয়াদ পূর্ণ করেছিলেন। কেননা এটাই নবী চরিত্রের জন্য শোভনীয় যে, কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ঐচ্ছিক দু’বছরও তিনি পূর্ণ করবেন’।[19]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন,
أفرسُ الناس ثلاثةٌ: صاحبُ يوسفَ حين قال لإمرأته أكرمى مثواه عسى أن ينفعنا، وصاحبةُ موسى حين قالت يا ابت استأجره إن خير من استأجرت القوىُّ الامين، وابوبكر الصديق حين استخلف عمرَ رضى الله عنه-
‘সর্বাধিক দূরদর্শী ব্যক্তি ছিলেন তিনজন: ১- ইউসুফকে ক্রয়কারী মিসরের আযীয (রাজস্বমন্ত্রী), যখন তিনি তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘একে সম্মানের সাথে রাখ, হয়তবা সে আমাদের কল্যাণে আসবে’ ২- মূসার স্ত্রী, যখন (বিবাহের পূর্বে) তিনি স্বীয় পিতাকে বলেছিলেন, ‘হে পিতা, এঁকে কর্মচারী নিয়োগ করুন। নিশ্চয়ই আপনার শ্রেষ্ঠ সহযোগী তিনিই হ’তে পারেন, যিনি শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’ এবং ৩- আবুবকর ছিদ্দীক, যখন তিনি ওমরকে তাঁর পরবর্তী খলীফা মনোনীত করেন’।[20]
৩য় পরীক্ষা: মিসর অভিমুখে যাত্রা ও পথিমধ্যে নবুঅত লাভ
মোহরানার চুক্তির মেয়াদ শেষ। এখন যাবার পালা। পুনরায় স্বদেশে ফেরা। দুরু দুরু বক্ষ। ভীত-সন্ত্রস্ত্র মন। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। তবুও যেতে হবে। পিতা-মাতা, ভাই-বোন সবাই রয়েছেন মিসরে। আল্লাহর উপরে ভরসা করে স্ত্রী-পরিবার নিয়ে বের হ’লেন পুনরায় মিসরের পথে। শুরু হ’ল তৃতীয় পরীক্ষার পালা।
উল্লেখ্য, দশ বছরে তিনি দু’টি পুত্র সন্তান লাভ করেন এবং শ্বশুরের কাছ থেকে পান এক পাল দুম্বা। এছাড়া তাক্বওয়া ও পরহেযগারীর আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ তো তিনি লাভ করেছিলেন বিপুলভাবে।
পরিবারের কাফেলা নিয়ে মূসা রওয়ানা হ’লেন স্বদেশ অভিমুখে। পথিমধ্যে মিসর সীমান্তে অবস্থিত সিনাই পর্বতমালার তূর পাহাড়ের নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছলে হঠাৎ স্ত্রীর প্রসব বেদনা শুরু হ’ল। এখুনি প্রয়োজন আগুনের। কিন্তু কোথায় পাবেন আগুন। পাথরে পাথরে ঘষে বৃথা চেষ্টা করলেন কতক্ষণ। প্রচন্ড শীতে ও তুষারপাতের কারণে পাথর ঘষায় কাজ হ’ল না। দিশেহারা হয়ে চারিদিকে দেখতে লাগলেন। হঠাৎ অনতিদূরে আগুনের হলকা নজরে পড়ল। আশায় বুক বাঁধলেন। স্ত্রী ও পরিবারকে বললেন, ‘তোমরা এখানে অবস্থান কর। আমি আগুন দেখেছি। সম্ভবতঃ আমি তা থেকে তোমাদের জন্য কিছু আগুন জ্বালিয়ে আনতে পারব অথবা সেখানে পৌঁছে পথের সন্ধান পাব’ (ত্বোয়াহা ২০/১০)। একথা দৃষ্টে মনে হয়, মূসা পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন।[21] পথিমধ্যে শাম অঞ্চলের শাসকদের পক্ষ থেকে প্রধান সড়কে বিপদাশংকা ছিল। তাই শ্বশুরের উপদেশ মোতাবেক তিনি পরিচিত রাস্তা ছেড়ে অপরিচিত রাস্তায় চলতে গিয়ে মরুভূমির মধ্যে পথ হারিয়ে ডান দিকে চলে তূর পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছে গেলেন। মূলতঃ এ পথ হারানোটা ছিল আল্লাহর মহা পরিকল্পনারই অংশ।
মূসা আশান্বিত হয়ে যতই আগুনের নিকটবর্তী হন, আগুনের হল্কা ততই পিছাতে থাকে। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, সবুজ বৃক্ষের উপরে আগুন জ্বলছে। অথচ গাছের পাতা পুড়ছে না; বরং তার উজ্জ্বলতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। বিস্ময়ে অভিভূত মূসা এক দৃষ্টে আগুনটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ এক গুরুগম্ভীর আওয়ায কানে এলো তাঁর চার পাশ থেকে। মনে হ’ল পাহাড়ের সকল প্রান্ত থেকে একই সাথে আওয়ায আসছে। মূসা তখন তূর পাহাড়ের ডান দিকে ‘তুবা’ (طُوَى) উপত্যকায় দন্ডায়মান। আল্লাহ বলেন,
فَلَمَّا أَتَاهَا نُودِيَ يَا مُوسَى- إِنِّي أَنَا رَبُّكَ فَاخْلَعْ نَعْلَيْكَ إِنَّكَ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًى- (طه ১১-১২)-
‘অতঃপর যখন তিনি আগুনের কাছে পৌঁছলেন, তখন আওয়ায এলো, হে মূসা!’ ‘আমিই তোমার পালনকর্তা। অতএব তুমি তোমার জুতা খুলে ফেল। তুমি পবিত্র উপত্যকা তুবায় রয়েছ’ (ত্বোয়াহা ২০/১১-১২)। এর দ্বারা বিশেষ অবস্থায় পবিত্র স্থানে জুতা খোলার আদব প্রমাণিত হয়। যদিও পাক জুতা পায়ে দিয়ে ছালাত আদায় করা জায়েয।[22] অতঃপর আল্লাহ বলেন,
وَأَنَا اخْتَرْتُكَ فَاسْتَمِعْ لِمَا يُوحَى- إِنَّنِي أَنَا اللهُ لآ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِي- إِنَّ السَّاعَةَ ءاَتِيَةٌ أَكَادُ أُخْفِيهَا لِتُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا تَسْعَى- فَلاَ يَصُدَّنَّكَ عَنْهَا مَنْ لاَ يُؤْمِنُ بِهَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ فَتَرْدَى- (طه ১৩-১৬)-
‘আর আমি তোমাকে মনোনীত করেছি। অতএব তোমাকে যা প্রত্যাদেশ করা হচ্ছে তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাক’। ‘নিশ্চয় আমিই আল্লাহ। আমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণে ছালাত কায়েম কর’। ‘ক্বিয়ামত অবশ্যই আসবে, আমি তা গোপন রাখতে চাই; যাতে প্রত্যেকে তার কর্মানুযায়ী ফল লাভ করতে পারে’। ‘সুতরাং যে ব্যক্তি ক্বিয়ামতে বিশ্বাস রাখে না এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে যেন তোমাকে (ক্বিয়ামত বিষয়ে সতর্ক থাকা হ’তে) নিবৃত্ত না করে। তাহ’লে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে’ (ত্বোয়াহা ২০/১৩-১৬)।
এ পর্যন্ত আক্বীদা ও ইবাদতগত বিষয়ে নির্দেশ দানের পর এবার কর্মগত নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলছেন,
وَمَا تِلْكَ بِيَمِينِكَ يَا مُوسَى- قَالَ هِيَ عَصَايَ أَتَوَكَّأُ عَلَيْهَا وَأَهُشُّ بِهَا عَلَى غَنَمِي وَلِيَ فِيهَا مَآرِبُ أُخْرَى- قَالَ أَلْقِهَا يَا مُوسَى- فَأَلْقَاهَا فَإِذَا هِيَ حَيَّةٌ تَسْعَى- قَالَ خُذْهَا وَلاَ تَخَفْ سَنُعِيدُهَا سِيرَتَهَا الْأُولَى- (طه ১৭-২১)-
‘হে মূসা! তোমার ডান হাতে ওটা কি?’ ‘মূসা বললেন, এটা আমার লাঠি। এর উপরে আমি ভর দেই এবং এর দ্বারা আমার ছাগপালের জন্য গাছের পাতা ঝেড়ে নামাই। তাছাড়া এর দ্বারা আমার অন্যান্য কাজও চলে’। ‘আল্লাহ বললেন, হে মূসা! তুমি ওটা ফেলে দাও’। ‘অতঃপর তিনি ওটা (মাটিতে) ফেলে দিতেই তা সাপ হয়ে ছুটাছুটি করতে লাগল’। ‘আল্লাহ বললেন, তুমি ওটাকে ধর, ভয় করো না, আমি এখুনি ওকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেব’ (ত্বোয়াহা ২০/১৭-২১)।
এটি ছিল মূসাকে দেওয়া ১ম মু‘জেযা। কেননা মিসর ছিল ঐসময় জাদুবিদ্যায় শীর্ষস্থানে অবস্থানকারী দেশ। সেখানকার শ্রেষ্ঠ জাদুকরদের হারিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই নবুঅতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা আবশ্যক ছিল। সেজন্যই আল্লাহ মূসাকে সবদিক দিয়ে প্রস্ত্তত করে দিচ্ছিলেন। এর ফলে মূসা নিজের মধ্যে অনেকটা শক্তি ও স্বস্তি লাভ করলেন।
১ম মু‘জেযা প্রদানের পর আল্লাহ তাকে দ্বিতীয় মু‘জেযা প্রদানের উদ্দেশ্যে বললেন,
وَاضْمُمْ يَدَكَ إِلَى جَنَاحِكَ تَخْرُجْ بَيْضَاء مِنْ غَيْرِ سُوءٍ آيَةً أُخْرَى- لِنُرِيَكَ مِنْ آيَاتِنَا الْكُبْرَى- (طه ২২-২৩)-
‘তোমার হাত বগলে রাখ। তারপর দেখবে তা বের হয়ে আসবে উজ্জ্বল ও নির্মল আলো হয়ে, অন্য একটি নিদর্শন রূপে’। ‘এটা এজন্য যে, আমরা তোমাকে আমাদের বিরাট নিদর্শনাবলীর কিছু অংশ দেখাতে চাই’ (ত্বোয়াহা ২০/২২-২৩)।
Wednesday, May 20, 2015
হযরত মূসা ও হারুন (আঃ) এর ২য় অংশ
Tags
# নবীদের কাহিনী
About Unknown
Templatesyard is a blogger resources site is a provider of high quality blogger template with premium looking layout and robust design. The main mission of templatesyard is to provide the best quality blogger templates.
নবীদের কাহিনী
লেবেলসমূহ:
নবীদের কাহিনী
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment